বিজ্ঞাপনের পরিধি ছোট হয় নাই বরং বেড়েছে কিন্তু আমরা সেই টাকাগুলো আমাদের ঘরে আনতে পারছি না। সুতরাং বাজার ছোট, ব্যবসা নাই, তাই লোক ছাঁটাই, এই নাকিকান্নার অন্তত আমার কাছে কোনো আবেদন নাই
এইতো ক’দিন আগে বিশ্বখ্যাত একটি গণমাধ্যমে পেশাগত ঝুঁকি নিয়ে দারুণ একটা রিপোর্ট এসেছে। নিঃসন্দেহে কৃতজ্ঞতা জানাই তাদের প্রতি। সেইসাথে তাদেরকেও অনুরোধ জানাই, নৈতিক দায়িত্ব থেকেই এই শিল্পের এই কঠিন অবস্থায় অন্তত ১০ জনকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য। রোহিঙ্গাদের নিয়ে অনেক বড় বড় দেশ অনেক নীতিবাক্য ছোড়েন কিন্তু ১ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীরও দায়িত্ব নেন না, যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্ত্বেও।
তবে এখানে আসলেই সুযোগ নেই, বিশ্বব্যাপী তারাও অনেক চাপের মুখে আছেন। তাদের আমি চাকরি দেওয়ার অনুরোধটি প্রত্যাহার করে নিলাম।
কিন্তু কেন সুযোগ নেই? সেই প্রশ্নটার উত্তর আমরা খুঁজছি না, আমি শুধু টেলিভিশনশিল্প নিয়েই দুটি কথা বলতে চাই।
টেলিভিশন কি মানুষ এখন শুধুই ডিশ অ্যান্টেনার মাধ্যমে কেবলে দেখছে? বাক্স থেকে মুঠোফোনে চলে এসছে টেলিভিশন। যেহেতু বিজ্ঞাপন দাতারা মোরসেগমেন্টেড অডিয়েন্স পাচ্ছেন অনলাইনে সেহেতু তারা অনলাইন নির্ভর হয়েছেন, তাও আজ ৫ বছর আগে থেকেই। কিন্তু কয়টা টেলিভিশন তাদের সম্প্রচার কেবল থেকে অনলাইনের তরঙ্গে নিয়ে যেতে পেরেছেন? প্রত্যেক বিজ্ঞাপনদাতার প্রথম পছন্দ অনলাইন ভার্সন আর সে কারণেই তারা তাদের বিনিয়োগের শতকরা ৬০ ভাগ শিফট করেছেন অনলাইনে। কারা পাচ্ছে সেই টাকা? মূলত সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব আর গুগল, এই প্ল্যাটফর্মগুলো কি আমার গণমাধ্যম শিল্পের অংশ! বিজ্ঞাপনের পরিধি ছোট হয় নাই বরং বেড়েছে কিন্তু আমরা সেই টাকাগুলো আমাদের ঘরে আনতে পারছি না। সুতরাং বাজার ছোট, ব্যবসা নাই, তাই লোক ছাঁটাই, এই নাকি কান্নার অন্তত আমার কাছে কোনো আবেদন নাই।
ট্রেডিশনাল মার্কেটিং বাদ দিয়ে এখন সেগমেন্টেড টার্গেট বেইজড মার্কেটিংয়ে যেতে হবে। ক'জন দক্ষ আছেন, ক'জন আছেন প্রোডাক্ট ডেভেলমেন্ট আর স্ট্র্যাটিজিক মার্কেটিংয়ে দক্ষ! এই মাল্টি টাস্কিং ক্যাপাবল কর্মীদের সামনে আনতে না পারলে কাঁদতেই হবে, সমাধান হবে না।
আমার দেশেই এখন কয়েকটি টেলিভিশন শুধুমাত্র অনলাইনের জন্য আলাদা করে অনুষ্ঠান বানাচ্ছেন, সেগুলো আলাদাভাবে বিপণন হচ্ছে। শুধুই কি প্রোডাক্ট আপনাকে টাকা দেবে? মার্কেটিং থেকে বেড়িয়ে এসে মোর কনসেনট্রেট করতে হবে কমিউনিকেশনে। অনলাইনগুলো কেন ভিজুয়াল মিডিয়া স্ট্রং করছে? কারণ আপনি এখানে খেলতে আসছেন না। কিন্তু ভিজুয়ালি আপনার সক্ষমতার ধারে-কাছেও তারা নাই। আপনার স্টুডিও থেকে শুরু করে ইনফ্রাস্ট্রাকচারের সব কিছুই আছে। শুধু নাই অনলাইনের জগতের জন্য প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্টের জন্য আন্তরিকতা আর সেই প্রোডাক্ট বিক্রি করার মতো দক্ষ জনবল। জনবল আপনার পাশেই আছেন শুধু চিনতে সমস্যা!
এ তো গেল একটি দিক, আপনি কি জানেন না, এই বাজারেই আরো অনেক জায়গায় বিজ্ঞাপনের নতুন অর্থখাত আছে। তার কতোটা আপনি আমি নিতে পারছি আমাদের ঘরে?
পণ্যের প্রচারের ক্ষেত্রে শুধুই কি বিজ্ঞাপন আমাদের শেষ ভরসা! বিশেষ বিশেষ পণ্যের সংশ্লিষ্ট শিল্পগুলোকে নিয়ে ভাবনার জায়গায় আমাদের কতোটা দখল আছে? তাদের কতোটা কাছে আমরা থাকতে পারছি? কেন আমরা পুরো শিল্পের উন্নয়নের জন্য কাজ করতে পারছি না সেই শিল্পের অর্থায়নে।
কেন এখনো দেশের মেগা প্রজেক্টগুলোর নলেজ ম্যানেজমেন্ট আর তার প্রচারে আমাদের নেই কোনো আধুনিকতার ছাপ! কেন সেই সেমিনার সিম্পোজিয়াম, পোস্টার, মাঠে প্রোজেক্টর আর মাইকিংই আমাদের ভরসার সবটুকু জুড়ে? কেন সেই প্রচারণায় আমাদের টার্গেট অডিয়েন্স মার্ক হয় না, আগে থেকেই কেন সেই কমিউনিকেশনে থাকে না কোনো স্ট্র্যাটিজি, কোনো পলিসি?
আমরা প্রায়শই তারকাদের যুক্তকরি আমাদের বিভিন্ন কাজে-কর্মে, কেন তাদেরকে তাদের কোটি কোটি দর্শক ভক্তকুলকে সম্পৃক্ত করা যায় না সেই পণ্যের মাধ্যমে!
গণমাধ্যমের বিপণনে আর সেকেলে ধ্যান-ধারণা ভাত পাচ্ছে না এটুকু নিশ্চিত। চাই নিত্যনতুন আইডিয়া আর তার দ্রুত বাস্তবায়ন। নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি তো বটেই চাই পুরাতন বাজারগুলোকে নতুনভাবে আবিষ্কার করা। তাদেরকে নতুন আর স্পেসিফিক ওয়ান টু ওয়ান মার্কেটিং এ অভ্যস্ত করার দায়িত্বটুকুও কিন্তু আমাদেরই।
এদিকে, দেখুন ব্র্যান্ড প্রমোশনের পরিধি পরিবর্তিত হয়েছে কিন্তু সেই সুবাদে ইনোভেটিভ কি করতে পেরেছেন আপনি সেখানে? এই ধরুন, পত্রিকাগুলোর বড় আয় আসে সাপ্লিমেন্ট থেকে, টেলিভিশনে কি সাপ্লিমেন্ট করা যায় না? কই দেখলাম না তো, এমন অজস্র বিষয় আছে। শুধু পণ্যের বিজ্ঞাপনের পিছে ছুটে হবে না আর, চেতনার পিছনেও একটু সময় দিতে হবে। চেতনার ছড়িয়ে দিতেও বাজেট আছে, আর সেটা নিজের করে নিতে প্রস্তুত নন আপনারা। নতুন করে ভাবনার প্রয়োজন আছে বিস্তর। সেটুকু করতে পারলে ৩০টা টেলিভিশন মাসে গড়ে ১ কোটি টাকা শুধু ইনোভেটিভ কমিউনিকেশন থেকেই আনতে পারে, সেদিকে নজর না দিয়ে শুধু লোক ছাঁটাই আর এই কান্নাকাটি সত্যিই ভালোলাগে না।
একবুক চাপা কষ্ট নিয়ে ১১ বছরের সাংবাদিকতা ফেলে যোগ দিয়েছি কমিউনিকেশনে। মুদ্রার দুই পিঠ চিলের চোখে দেখেছি আমি। সেই অধিকার থেকেই দুই লাইন লিখলাম। সবাই আমার ভাবনার ছোট্ট ভুলগুলো ক্ষমাসুন্দর চোখেই দেখবেন আশা করি। এই কথাগুলো গেল দুই বছর বিভিন্ন আড্ডায় বলে আসছি কোনো লাভ হয়নি। এখন যখন পিঠ ঠেকেই গেছে তখন একটা চেষ্টাই না হয় হোক, ইতিবাচক উপায়ে!
আমার সাংবাদিক সহকর্মীরা ভালো থাকলেই দেশ ভালো থাকবে। স্বাধীন বাংলাদেশে এই মানুষগুলোর আত্মত্যাগকে সম্মান জানানোর মতো সত্যিই কেউ নেই। সবার অধিকার প্রশ্নে সোচ্চার হওয়াই যাদের পেশা, তাদের নিজের অধিকার প্রশ্নে থাকতে হয় বোবা! টেলিভিশনশিল্পে সুদিন আসবেই!
মূল সংবাদ: দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউনের মতামত বিভাগে প্রকাশিত ০৭:৩৪ রাত নভেম্বর ২১, ২০১৯